হযরত ইদ্রিস আলাইহিস সাল্লামের জীবনী

আজকের পর্বে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হযরত ইদ্রিস আলাইহিস সাল্লামের জীবনী তুলে ধরবো । ইদ্রিস আলাইহিস সাল্লাম যিনি মুসলমানদের নিকট হজরত ইদ্রিস আলাইহিস সাল্লাম নামে পরিচিত, ইসলামী ইতিহাস অণুসারে মানবজাতির উদ্দেশ্যে প্রেরিত দ্বিতীয় নবী। মুসলমানদের বিশ্বাস অণুসারে তিনি ইসলামের প্রথম নবী আদম এর পর স্রষ্টার নিকট হতে নবীত্ব লাভ করেন। তার জন্মস্থান নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে তিনি ইরাকের বাবেলে জন্মগ্রহণ করেন। আবার কারো মতে তিনি মিশরে জন্মগ্রহণ করেন।

ইসলামী ভাষ্য মতে ইসলামের নবী মুহাম্মাদ মিরাজের রাতে চতুর্থ আসমানে তার সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। ধারণা করা হয় তিনিই সর্বপ্রথম কলম এবং কাপড় সেলাই করার বিদ্যা আবিস্কার করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান, অংকশাস্ত্র এবং অস্ত্রের ব্যবহারও তিনিই সর্বপ্রথম আবিস্কার করেন। ইদ্রীস আলাইহিস সাল্লাম এর নাম ও বংশ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে বিরাট মতভেদ আছে।

বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে ইসহাকের মতে, তিনি হলেন ইসলামের নবী নূহ এর দাদা। তার আসল নাম হলো আখনূখ। ইদ্রীস আলাইহিস সাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উপাধি। কিংবা আরবি ভাষায় তার নাম ইদ্রীস আলাইহিস সাল্লাম আর হিব্রু ও সুরইয়ানী ভাষায় তার নাম হলো আখনূখ। ইবনে ইসহাক তার বংশধারা বর্ণনা করেনঃ আখনূখ (ইদ্রীস) আলাইহিস সাল্লাম ইবনে ইয়ারুদ ইবনে মাহলাইল। এভাবে তার বংশধারা আদম এর পুত্র শীষ এর সাথে মিলিত হয়। আরেকদল ঐতিহাসিকের মতে ইদ্রীস ইসরাইল বংশীয় নবী। আর ইদ্রীস আলাইহিস সাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও ইলয়াস একই ব্যক্তির নাম ও উপাধি।

তার জীবন সম্পর্কে যতোটুকু জানা যায়, তা হলো ছোটবয়সে তিনি শীষএর ছাত্র ছিলেন। বড় হওয়ার পর আল্লাহ তাকে নুবুওয়্যত দান করেন। তখন তিনি আদম এর ওপরে অবতীর্ণ শরীয়ত ত্যাগ করতে মন্দলোকদের নিষেধ করেন। অল্পকিছু লোক তার আহ্বানে সাড়া সৎপথে ফিরে আসলো। আর অধিকাংশ মানুষই তার বিরোধিতা করলো। তাই তিনি তার অণুসারীদের নিয়ে দেশ ছেড়ে যেতে মনস্থ করলেন। কিন্তু তার অণুসারীরা মাতৃভূমি ছাড়তে গড়িমসি করে বললো, বাবেলের মতো দেশ ছেড়ে গেলে এমন দেশ আর কোথায় পাব? উত্তরে তিনি বললেন যদি আমরা আল্লহর জন্য হিজরত করি তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে এরচে উত্তম প্রতিদান দেবেন।

এরপর তিনি নিজের অণুসারীদেরসহ দেশ ছেড়ে রওয়ানা হলেন এবং একসময় মিশরের নীলনদের তীরে এসে পৌঁছলেন। এ জায়গা দেখে তারা আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন এবং এখানেই বসবাস করতে লাগলেন। তিনি সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধে ব্রতি হন। কথিত আছে তার যুগে বাহাত্তরটি ভাষা ছিলো এবং এর সবকটি ভাষাই তিনি পারতেন। ইদ্রীস আলাইহিস সাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বয়স সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। বাইবেলের বর্ণনা অণুযায়ী ইদ্রীস আলাইহিস সাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনশত পয়ষট্টি বছর জীবিত থাকেন। তবে আরেক বর্ণনানুযায়ী তিনি বিরাশি বছর জীবিত থাকেন। তার মৃত্যুবরণ করা সম্পর্কেও মতভিন্নতা রয়েছে। কারো কারো মতে তিনি মৃত্যুবরণ করেননি। বরং আল্লাহ তাকে চতুর্থ আসমানে তুলে নিয়েছেন। তবে বেহেস্তে থেকে যাওয়ার কাহিনী গুলো ইসরাঈলী বর্ণণা।

স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ:
এক আগন্তুক ব্যক্তি তিনদিন পর্যন্ত হজরত ইদরিস আলাইহিস সাল্লামের সাহচর্যে থাকলেন। তার আচরণাদি লক্ষ্য করে হজরত ইদরিস আলাইহিস সাল্লামের মনে সন্দেহের উদ্রেক হলো যে, এ ব্যক্তি নিশ্চয় কোনো মানুষ নয়। অতএব তিনি বললেন, আল্লাহর কসম আপনি আপনার প্রকৃত পরিচয়টা বলুন। আগন্তুক বললো, আমি কোনো মানুষ নযই। আমি একজন ফেরেশতা। আমার নাম মালাকুল-মওত আজরাঈল।

হজরত ইদরিস আলাইহিস সাল্লাম বললেন, ‘আপনিই কি দুনিয়ার যাবতীয় প্রাণীর জান কবজ করিয়া থাকেন?’ মালাকুল-মওত বললেনঃ হাঁ।

হজরত ইদরিস আলাইহিস সাল্লাম বললেন, ‘তবে মনে হয় আপনি আমার জান কবজ করতেই এসেছেন’।

মালাকুল-মওত বললেন, ‘না, আপনার সাথে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করতে এসেছি। আমার একান্ত বাসনা আপনিও আমার এ প্রস্তাবে রাজী হবেন’।

হজরত ইদরিস আলাহিস সাল্লাম বললেন, ‘আমি আপনার সাথে এক শর্তে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করতে রাজী যদি আপনি আমাকে একবার মৃত্যুর অবস্থাটা উপভোগ করান। যদি আপনি আমাকে এখনই একবার মৃত্যুর অবস্থাটা উপভোগ করান তাহলে আমার অনেক উপকার হতো। মৃত্যুর ভয়ে আমি বেশি করে আল্লাহর ইবাদত করতে পারতাম।’

মালাকুল-মওত বললেন, ‘আল্লাহর অনুমতি ছাড়া আমি একাজ করতে পারি না। আল্লাহ এখনো আপনার জান কবজ করার হুকুম আমাকে দেননি।’

হজরত ইদরিস আলাইহিস সাল্লাম বললেন, ‘আপনি আল্লাহর নিকট হতে অনুমতি চেয়ে নিন।’

মালাকুল-মওত আল্লাহর নিকট অনুমতি প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাঁকে অনুমতি দেন। অনুমতি পেয়ে মালাকুল-মওত হজরত ইদরিস আলাইহিস সাল্লাম এর জান কবজ করলেন। জান কবজ করার পর মালাকুল-মওত আজরাঈল পুনঃরায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন হজরত ইদরিস আলাইহিস সাল্লাম এর জান ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা কবুল করলেন।

অতঃপর ফেরেশতা আজরাঈল হজরত ইদরিস (আলাইহিস সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভাই ইদরিস! জান কবজ করার সময় আপনার কিরূপ লেগেছিল?’

হজরত ইদরিস আলাইহিস সাল্লাম বললেন, ‘কোনো জীবিত প্রাণীর শরীরের চামড়া মাথা হতে পা পর্যন্ত খসে তুলে ফেললে প্রাণীটির যে রূপ কষ্ট হয় আমারও সেরূপ কষ্ট হয়েছে।’

মালাকুল-মওত বললেন, ‘ভাই ইদরিস! আমি আজ পর্যন্ত যত জান কবজ করেছি এত সহজে কারো জান কবজ করিনি।’

কৌশলে বেহেশতে গমন: হজরত ইদরিস আলাইহিস সাল্লাম আজরাঈলকে বললেন, ‘আমার মনে দোজখ দেখার খুব স্বাদ জেগেছে। যদি আপনি আমাকে দোজখ দেখাতেন তবে আমি দোজখের ভয়ে ইবাদত-বন্দেগীতে আরও বেশি মনোযোগী হতে পারতাম।

মালাকুল-মওত তাঁকে দোজখ দেখাতে দোজখের দরজায় নিয়ে গেলেন। তিনি দোজখ দেখার পর বললেন, ‘ভাই আজরাঈল! আমার মনে বেহেশত দেখার বড়ই স্বাদ জেগেছে। যদি আপনি আমার এই স্বাদটি পূর্ণ করতেন তাহলে আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকতাম।’

মালাকুল-মওত বললেন, ‘যদি আপনি আমাকে কথা দেন যে বেহেশত দেখেই আপনি আমার নিকট ফিরে আসবেন তাহলে আমি আপনাকে বেহেশত দেখাতে পারি।’

হজরত ইদরিস আলাইহিস সাল্লাম তাতে রাজী হলে মালাকুল-মওত তাঁকে বেহেশত দেখাতে নিয়ে গেলো। বেহেশতের দরজায় আসলে হজরত ইদরিস আলাইহিস সাল্লাম তাঁর পায়ের জুতা খুলে বেহেশতে প্রবেশ করলেন। তিনি কিছু সময় বেহেশতে ঘুরাফেরা করলেন। এরপর তিনি মালাকুল-মওতের কাছে ফিরে এসে নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলেন। পরক্ষণেই তিনি এক দৌঁড়ে আবার বেহেশতে ঢুকে গেলেন। মালাকুল-মওত তাঁকে ডেকে বললো, ‘ভাই ইদরিস! আপনি আবার বেহেশতে ঢুকলেন কেন? তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসুন। আমি আপনাকে আবার পৃথিবীতে পৌঁছে দেব।’

হজরত ইদরিস আলাইহিস সাল্লাম বেহেশতের ভিতর থেকে জবাব দিলেন, ‘ভাই আজরাঈল! আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ প্রত্যেক প্রাণীই একবার মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে এবং একবার দোজখ না দেখে কেউ বেহেশতে যেতে পারবে না। আমি তো একবার মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করলাম এবং দোজখও দেখলাম। তারপর বেহেশত হতে বের হয়ে আপনাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করলাম। অতএব এখন আমি আর বেহেশত হতে বের হবো না। আপনি আপনার কাজে চলে যেতে পারেন।’

মালাকুল-মওত হজরত ইদরিস আলাইহিস সাল্লাম এর জবাব শুনে কর্তব্য স্থির করতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

আল্লাহ তা’আলা তখন হজরত আজরাঈল আলাইহিস সাল্লামকে লক্ষ্য করে বললেনঃ আজরাঈল! ইদরিসকে বেহেশতে থাকতে দাও। তাঁর ভাগ্যে আমি এরূপ ঘটনায় লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলাম। অতঃপর হজরত ইদরিস আলাইহিস সাল্লাম মহাসুখে বেহেশতে বসবাস করতে লাগলেন।

এটাই ছিল ইদ্রিস আলাইহিস সাল্লামের সংক্ষিপ্ত জীবনী। আজকের জীবনী পর্বটি কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। ভাল থাকুন সবাই আসসালামু আলাইকুম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *